প্রযুক্তিখাতে কর চাপিয়ে না দেওয়ার আহ্বান তরুণ উদ্যোক্তাদের
‘আর ইউ রেডি ফর এআই?’ এই প্রতিপাদ্যে নিয়ে দিপব্যাপী রাজধানীতে হয়ে গেলো ‘ইয়ুথ টেক সামিট’। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সময়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্টর (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) রাজত্বে বাংলাদেশের তরুণদের অবস্থানকে সুসংহত করতেই এ আয়োজন। যেখানে-তরুণ উদ্যোক্তারা জানান, তাঁরা প্রযুক্তিখাতে করারোপ নিয়ে উদ্বিগ্ন। উদিয়মান এই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উপর নতুন কর চাপিয়ে না দেওয়ার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে তরুণ উদ্যোক্তাদের হাতে করারোপ না করা সম্বলিত বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।


বুধবার (২২মে) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি)-এর মিলনায়তনে সকালেই বসেছিলো দেশের প্রথম ইয়্যুথ টেক সামিট। তরুণ উদ্যোক্তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ গ্রহণ ছিলো চোখে পড়ার মতো। সেখানেই এসব আহ্বান জানান তরুণ উদ্যোক্তারা।
১৪টি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সামিটে দুই শতাধিক তরুণ অংশ নেন।
সামিটের বিভিন্ন সেশনে অংশ নিয়ে আইটি খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন টিপস শিখেছে অংশগ্রহণকারীরা। এছাড়াও অল্প বয়সে যারা সফল হয়েছে তাদের জার্নিটা (পথচলা) কেমন ছিলো সেসব বিষয়সহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এআই-কিভাবে প্রভাবিত করছে, প্রযুক্তির ভবিষ্যতের নানা দিকের গল্পগুলো গভীর মনোযোগী হয়ে শুনতে দেখা দেখা গেছে।
অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পার্ট ছিলো-দেশের ২০ জন সফল ও তরুণ উদ্যোক্তা তাদের এগিয়ে যাওয়ার গল্প বলা সেশনটি। তারা কিভাবে সফল হয়েছে, কোন পদ্ধতিগুলো অ্যাপ্লাই করেছে সেগুলো বলা সহ তাদের বক্তব্যে নতুন প্রযুক্তি, বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো প্রাধান্য পায়।
উপস্থিত তরুণদের ৪৫ শতাংশই ছিলো ২৫ বছরের নিচে। মোটিভেশনাল স্পিকার গোলাম সামদানি ডনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উইন্ড অ্যাপ সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহাদ আহমেদ গল্প বলতে গিয়ে বলেন, আমাদের প্রজন্মটা আচরণে অস্থির। তবে সফল হতে হলে চার-ছয় হাঁকানোর বদলে এক-দুই করে ক্রিজে থেকে রান করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
তিনি বলেন যে যাই করেন না-কেন লেগে থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে মঞ্চে গিয়ে নিজের বলার মতো গল্পের প্রতিষ্ঠাতা ইকবাল বাহার ভালোবাসার কাজ ও সৎসঙ্গ বেছে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন- দেশের জন্য বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরির কাজটি করছেন। আমাদের ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তারা দেশে চার লক্ষাধিক কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন।
এরপরই বক্তব্য রাখেন প্রাণ আর এফ এল গ্রুপ প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেন- আমি আজ আপনাদের কাছ থেকে শিখলাম। আজ আমি স্টুডেন্ট। আমি এখন চীনের কুনমিং এ ব্যবসা শুরু করছি। বিশ্বের ১৮০টি দেশে ছড়িয়ে আছে প্রাণ।
এসময় প্রাণকে স্টর্টআপে বিনিয়োগের আহ্বান জানান বিডিজবস প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর। প্রতি উত্তরে আহসান খান বললেন- প্রাণের বিনিয়োগের ঘাটতি নেই, ঘাটতি আছে মেধার। আমরা স্টার্টআপদের সাথে চলতে চাই।
মিত্র ফিনটেক লিমিটেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও কিশওয়ার হাসেমী জানলেন যখন দেশে রাইড শেয়ার নিয়ে ধুন্ধুমার, তখন সে কীভাবে ফিনটেক করলো। বললেন, একটা সময় হয়তো একজন উদ্যোক্তা কাজ করবেন বেশ কিছু এআই টুলস দিয়ে।
আরেকটু সহায়তা পেলেই আইএমএফ’র শর্তযুক্ত প্রাপ্ত ঋণ থেকে দেশের স্টার্টআপরাই সামনে আরো বড় বিনিয়োগ আনতে পারবে বলে মনে করেন এয়ারওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও সায়েম ফারুক।
এআই দাপটে চাকরি হারানোর ভীতি উড়িয়ে দিয়ে এডটেক ওস্তাদের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সৌরভ বড়ুয়া জানালেন, ইলার্নিং এ ডোপামিনটাই বড় চ্যলেঞ্জ। তবে এআই এমন কিছু জব সৃষ্টি করবে যার ভ্যালু হবে আরো বেশি।
এআই ও আইসিটি খাতের উদীয়মান ২০ জন উদ্যোক্তা এবং ১২ জন বক্তা এভাবে একে একে ক্যারিয়ারের অলিগলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন গল্পে গল্পে। আলোচনা হয় উদ্যোক্তা বান্ধব দৃষ্টিভঙ্গী, নীতিমালা নিয়েও।
ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ঘরে বসেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার স্টার্টআপ আমার ল্যাব সহপ্রতিষ্ঠাতা সিইও তাহরীম শাহ, ইনোভেসন টেক সিইও মো: মনিরুল আলম, ফিনটেক মিত্র সিইও কিশোর হাসমী, ইন্টার অ্যাক্টিভ কেয়ারস এর প্রতিষ্ঠাতা রেয়ার আল সামির, প্রোগ্রামিং হিরো সিওও আব্দুর রাকিব প্রমুখ নিজেদের উদ্যোগ সম্পর্কে তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে সবচেয়ে কম বয়সী উদ্যোক্তা ডেভস কোর সিইও আশরাফুল ইসলাম (২৪) জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রে এআই নিয়ে স্নাতক করার সময় তাকে শুনতে হয়েছে বাংলাদেশে ইন্টারনেট আছে কিনা এমন নেতিবাচক দৃষ্টভঙ্গী। এ থেকে উত্তরণে তরুণদের নিজে থেকে কথা বলা, নেটওয়ার্কিং, কমিউনিকেশন ও সহযোগী মানসিকতার অধিকারী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এছাড়াও ড্রিমজয় ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও তানভির হোসেন খান, ব্যাকস্পেসের প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল রহমান, সিগমাইন্ড সিইও আবু আনাস শোভন, মার্কোপোলোর সিইও তাসফিয়া তাসবীন, শিখোর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শাহির চৌধুরী, আইফার্মার সিইও ফাহাদ ইফাজ, ড. চাষি’র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মেদিনা আলী, লার্ন উইথ সুমিতের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও সুমিত সাহা সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।
সম্মেলনের সমাপনী বক্তব্যে ভিসিপিএবি প্রেসিডেন্ট শামীম আহসান সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, গ্র্যান্ট বা ফ্রি মানি চাই না। আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ চাই। এ জন্য আগামী বছর তিনেক কর অব্যাহতি রেখে পরে ধীরে ধীরে কর সহনীয় হারে কর আরোপের পরামর্শ দেন তিনি।
এই আয়োজনের মাধ্যমে আজ থেকে বাংলাদেশে এআই বিপ্লব শুরু হলো উল্লেখ করে অচিরেই বাংলাদেশ গ্লোবাল এআই ইউজ কেইসের রাজধানী হিসেবে পরিনত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বেসিস এর এই সাবেক সভাপতি। তিনি বলেন, এআই ভিত্তিক ওপেন সোর্সের মডেল দিয়ে ১৮ কোটি মানুষের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে গ্লোবাল এআই ইউজ কেইসের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। এত বিপুল জনসংখ্যার দেশের এআই ইউজ কেইস মডেল থেকে সারা বিশ্ব উপকৃত হতে পারে।
এজন্য ওপেন সোর্সের মডিউল ব্যবহারের প্রবলেম সলভিং সলিউশনে মনযোগী হওয়া এবং মার্কেট পোটেনসিয়াল খুঁজে নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বললেন, কো-ফাউন্ডিং টিম তৈরি করতে পারলে সফলতা আসবেই। তাই এআই ব্যবহার করে কিভাবে সেরা সমাধান দেয়া যায় সে দিকটাতেই মনোযোগী হতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিডিওএসএন সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান বললেন, আশির দশকে বুয়েট থেকে গুলিস্তানে চলেছি রিক্সায় শেয়ারে। অথচ আমরা ডট মেলাতে পারিনি। তাই উবার করতে পারি নাই। অন্যরা যে ভুল করেছি তা তোমরা করবে না। আমরা তোমাদের ভবিষ্যত বলে ভুল করেছি। কিন্তু তোমরা আসলে বর্তমান।
লাখ নয় একক নিয়ে লেগে থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি আরো বলেন, প্রতি ১৫ বছর পর একটা করে বিপ্লব হয়। এখন এআই বিপ্লব শুরু হয়েছে। এই বিপ্লব ধরতে হলে পড়তে হবে নেটওয়ার্কিং ও মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হবে। চার ঘণ্টা বক্তব্য শোনার পর চার ঘণ্টা পড়তে হবে।
বাংলাদেশ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজের নির্বাহী পরিচালক কে এম হাসান রিপন আমরা মিনিং ফুল অটোমেশন না হেডলেস অটোমেশন চাই সেটা আগে নির্ধারিত করতে হবে। একই সঙ্গে ওয়ান সাইট কিডস অল থেকে বেরিয়ে এসে ফেইস এভরি থিংক অ্যান্ড রাইজ দর্শনে নোঙর করতে হবে।
জেসিআই সভাপতি ইমরান কাদির সাম্প্রতিক সময়ে সানফ্রন্সিসকোতে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের দৃষ্টি ভঙ্গি তুলে ধরে বললেন, এতো ছোট জায়গায় ১৮ কোটি মানুষের বাজার তাদের কাছে বড় সম্ভাবনার। তাই ইতিবাচক হলেই অনেক কিছুই করা সম্ভব। এ কারণেই চ্যাটজিপিটির মতো লার্নিং টুলসগুলোর ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স উঠিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম (বিআইজেএফ) সভাপতি নাজনীন নাহার বললেন, আমরা ইন্ডাস্ট্রির ভালো গল্প গুলো বলতে পছন্দ করি। আজকের প্রতিটি গল্প মানে আমাদের দেশ। আমাদের সফলতা। এর ফলে একটি মঞ্চে ১২জন সফল উদ্যোক্তার এই গল্পটা আমাদের জন্য মাইলফলক হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরাম আহ্বায়ক আরিফুল হাসান অপু বললেন, সুযোগ পেলে আজকের তরুণরাই বিশ্বে দেশের মর্যাদাকে সমুন্বত করবে।
ক্যারিয়ার বিষয়ক লেখক মুহাম্মাদ আলতামিশ নাবিল উপস্থিত তরুণদের কুয়োর ব্যাঙ না হয়ে কিভাবে গতকাল থেকে আরেকটু ভালো থাকা যায় সেজন্য নেটওয়ার্কিং গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।
সম্মেলনের স্বাগ বক্তব্যে বিডিজবস এর প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেন, “যে এআই এর মতো নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে হলে এর নেতৃত্ব দিতে পারে শুধু তরুণরাই। তরুণ উদ্যোক্তাদের সব ধরণের সহায়তা প্রদান করতে হবে। আগামী বাজেটে যাতে নতুন কোনো কর এই উদ্যোক্তাদের উপরে না আরোপ করা হয় সেই ব্যাপারে তিনি সরকারকে আহবান জানান। কেননা প্রযুক্তির এই পরিবর্তনের সময়ে প্রচুর নতুন বিনিয়োগ দরকার নতুন এআই ভিত্তিক প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট করার জন্য। এই পর্যায়ে নতুন করে আয়কর বা ভ্যাট আরোপ করলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।’
সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে ছিল বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরাম, জেসিআই বাংলাদেশ, বিআইজেএফ, নিজের বলার মতো একটি গল্প ফাউন্ডেশন, বিডিঅ্যাপস, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইক্যুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ভিসিপিয়াব), ইয়্যুথ ইন টেক, ফিরল্যান্সার্স অফ বাংলাদেশ, রাইজ অ্যাবাভ অল, বিওয়াইএলসি,জিইএন, ইয়্যুথ ফর পলিসি, বিওয়াইএলসি, গ্লোবাল শেপার, জেন বাংলাদেশ এবং ড্যাফোডিল নেটওয়ার্ক।